Dhaka ১০:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম বার্ষিকী।

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৭:৩৩:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩
  • ৫৯৭ Time View

অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম বার্ষিকী।

আঃজলিল,স্টাফ রিপোর্টারঃ–

ঊণবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের সময় যাঁরা বাঙালির মননে চিরকালের জন্য স্থান করে নিয়েছেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদের অন্যতম। কবির ১৯৯ তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ।

১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে মধুসূদনের জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী, বিপুল পসার, প্রভূত অর্থ। গ্রামের বাস তুলে তিনি এক সময়ে কলকাতায় চলে আসেন। মধুসূদনের বয়স তখন ৭ বছর। ছোটবেলা থেকেই বিলাস বৈভবের মধ্যে আর মা জাহ্নবী দেবীর কাছে বসে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠলেন, ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে, পরে যার নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ। সহপাঠীরা তখন থেকেই তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়েছেন। যখন তখন মুখে মুখে কবিতা রচনা, কখনও বাংলায়, কখনও ইংরেজিতে। স্বপ্ন, ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়শোনা করার। তার আগে বাবা মা এক গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করায় বিদ্রোহ করলেন মধুসূদন। তাঁর তখন পছন্দ রেভারেন্ড কেষ্ট ব্যান্ডো বা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়ে দেবকীকে। রেভারেন্ড ব্যান্ডোর কাছেই খ্রিস্ট ধর্ম নিলেন মধুসূদন, কিন্তু দেবকীকে পাওয়া আর হল না। অর্থাভাব, ম্যাড্রাসে চলে গেলেন কাজের সন্ধানে। সেখানেই রেবেকা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করে নামের আগে মাইকেল বসান মধুসূদন দত্ত। চারটি সন্তান হয় তাঁদের, কিন্তু সেই বিয়ে সুখের হয়নি। সেই সময় তাঁর জীবনে আসেন হেনরিয়েটা নামে একজন, আমৃত্যু তাঁরা এক সঙ্গে ছিলেন। এখানে একটা কথা বলি, ভারতীয় টেনিস তারকা লিয়েন্ডার পেজের মায়ের দিক থেকে কয়েক প্রজন্ম আগের দাদামশাই ছিলেন মধুসূদন। যদিও এই সম্পর্কের কথা লি জানতেন না, আর জানার পরেও তাঁর মধ্যে বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

কবিতা ছিল মধুসূদনের প্রাণ। চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় তাঁর মাধ্যমে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা ব্ল্যাংক ভার্স তাঁরই সৃষ্টি। যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মেঘনাদ বধ কাব্য। তার কয়েকটি লাইন শুনি স্রোত আহমেদের পাঠে..

শুধুমাত্র এই একটি কাব্যগ্রন্থই মাইকেলকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে পারতো। কিন্তু এছাড়াও অসংখ্য ছোট বড় কবিতা, কয়েকটি নাটক এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, আর একেই কি বলে সভ্যতা, নামে দুটি প্রহসন রচনা করেছেন তিনি। আর একটা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ ইংরেজিতে অনুবাদ করে। ছোটবেলায় মায়ের কাছে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনি শুনে শুনে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করতেন মধুসূদন। মেঘনাদ বধ কাব্যে দেখা গেল তারই প্রতিফলন। হিন্দুদের কাছে রাম দেবতার মর্যাদা পান, আর রাবণ হলেন রাক্ষস, ভিলেন। বাল্মিকীর রামায়ণে কিন্তু আছে, রাবণ পুত্র মেঘনাদ, যিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন বলে আর এক নাম ইন্দ্রজিৎ, তাঁর বীরত্বের কাছে হার মেনে রামের ভাই লক্ষ্মণ রাবণের ভাই বিভীষণের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদকে হত্যা করেন। মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যে সেই মেঘনাদই হিরো। তাঁকে হত্যার দৃশ্যে কবি লিখেছেন..

বাবার মৃত্যুর পর মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড যান, কিন্তু অর্থ কষ্ট তাঁর পিছু ছাড়েনি। সেই সময় এবং তার পরেও তাঁকে অর্থ সাহায্য করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার জন্য চির ঋণী মধুসূদন তাঁকে বলতেন দয়ার সাগর। দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি শুরু করেন মধুসূদন। একটু অর্থাগম হতেই আবার বিলাসিতায় গা ভাসানো, মদ্যপান। শরীর ভাঙছে। হতাশা গ্রাস করছে। কবি বুঝতে পারছেন। বাংলা ভাষা ছেড়ে, দেশ ছেড়ে কী পেয়েছেন তার হিসেব মেলাতে গিয়ে হাহুতাশ করছেন..

মৃত্যু আসন্ন বুঝে নিজের সমাধি ফলকের জন্য লিখে রাখলেন এপিটাফ। অবশেষে ১৮৭৩ সালের ২৯শে জুন মাত্র ঊণপঞ্চাশ বছর বয়েসে তাঁর জীবনদীপ নিভে গেল। কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটারিতে কবির সমাধি স্থলে রয়েছে তাঁর মর্মর আবক্ষ মূর্তি। ফলকে উৎকীর্ণ তাঁরই লেখা লিপি..

তার মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণের পৌরাণিক কাহিনী থেকে সংগৃহীত হলেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবনার সংমিশ্রণে মধুসূদনের এ এক অপরূপ সৃষ্টি।

শেষ জীবনে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্থ ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ উঠেছিল। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় তিনি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

প্রেরক,

আঃজলিল

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

বোয়ালমারীতে চার বছর কর্মস্থলে না গিয়েও বেতন ভাতা নিচ্ছে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঝুমা !

অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম বার্ষিকী।

Update Time : ০৭:৩৩:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩

অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম বার্ষিকী।

আঃজলিল,স্টাফ রিপোর্টারঃ–

ঊণবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের সময় যাঁরা বাঙালির মননে চিরকালের জন্য স্থান করে নিয়েছেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদের অন্যতম। কবির ১৯৯ তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ।

১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে মধুসূদনের জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী, বিপুল পসার, প্রভূত অর্থ। গ্রামের বাস তুলে তিনি এক সময়ে কলকাতায় চলে আসেন। মধুসূদনের বয়স তখন ৭ বছর। ছোটবেলা থেকেই বিলাস বৈভবের মধ্যে আর মা জাহ্নবী দেবীর কাছে বসে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠলেন, ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে, পরে যার নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ। সহপাঠীরা তখন থেকেই তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়েছেন। যখন তখন মুখে মুখে কবিতা রচনা, কখনও বাংলায়, কখনও ইংরেজিতে। স্বপ্ন, ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়শোনা করার। তার আগে বাবা মা এক গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করায় বিদ্রোহ করলেন মধুসূদন। তাঁর তখন পছন্দ রেভারেন্ড কেষ্ট ব্যান্ডো বা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়ে দেবকীকে। রেভারেন্ড ব্যান্ডোর কাছেই খ্রিস্ট ধর্ম নিলেন মধুসূদন, কিন্তু দেবকীকে পাওয়া আর হল না। অর্থাভাব, ম্যাড্রাসে চলে গেলেন কাজের সন্ধানে। সেখানেই রেবেকা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করে নামের আগে মাইকেল বসান মধুসূদন দত্ত। চারটি সন্তান হয় তাঁদের, কিন্তু সেই বিয়ে সুখের হয়নি। সেই সময় তাঁর জীবনে আসেন হেনরিয়েটা নামে একজন, আমৃত্যু তাঁরা এক সঙ্গে ছিলেন। এখানে একটা কথা বলি, ভারতীয় টেনিস তারকা লিয়েন্ডার পেজের মায়ের দিক থেকে কয়েক প্রজন্ম আগের দাদামশাই ছিলেন মধুসূদন। যদিও এই সম্পর্কের কথা লি জানতেন না, আর জানার পরেও তাঁর মধ্যে বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

কবিতা ছিল মধুসূদনের প্রাণ। চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় তাঁর মাধ্যমে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা ব্ল্যাংক ভার্স তাঁরই সৃষ্টি। যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মেঘনাদ বধ কাব্য। তার কয়েকটি লাইন শুনি স্রোত আহমেদের পাঠে..

শুধুমাত্র এই একটি কাব্যগ্রন্থই মাইকেলকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে পারতো। কিন্তু এছাড়াও অসংখ্য ছোট বড় কবিতা, কয়েকটি নাটক এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, আর একেই কি বলে সভ্যতা, নামে দুটি প্রহসন রচনা করেছেন তিনি। আর একটা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ ইংরেজিতে অনুবাদ করে। ছোটবেলায় মায়ের কাছে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনি শুনে শুনে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করতেন মধুসূদন। মেঘনাদ বধ কাব্যে দেখা গেল তারই প্রতিফলন। হিন্দুদের কাছে রাম দেবতার মর্যাদা পান, আর রাবণ হলেন রাক্ষস, ভিলেন। বাল্মিকীর রামায়ণে কিন্তু আছে, রাবণ পুত্র মেঘনাদ, যিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন বলে আর এক নাম ইন্দ্রজিৎ, তাঁর বীরত্বের কাছে হার মেনে রামের ভাই লক্ষ্মণ রাবণের ভাই বিভীষণের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদকে হত্যা করেন। মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যে সেই মেঘনাদই হিরো। তাঁকে হত্যার দৃশ্যে কবি লিখেছেন..

বাবার মৃত্যুর পর মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড যান, কিন্তু অর্থ কষ্ট তাঁর পিছু ছাড়েনি। সেই সময় এবং তার পরেও তাঁকে অর্থ সাহায্য করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার জন্য চির ঋণী মধুসূদন তাঁকে বলতেন দয়ার সাগর। দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি শুরু করেন মধুসূদন। একটু অর্থাগম হতেই আবার বিলাসিতায় গা ভাসানো, মদ্যপান। শরীর ভাঙছে। হতাশা গ্রাস করছে। কবি বুঝতে পারছেন। বাংলা ভাষা ছেড়ে, দেশ ছেড়ে কী পেয়েছেন তার হিসেব মেলাতে গিয়ে হাহুতাশ করছেন..

মৃত্যু আসন্ন বুঝে নিজের সমাধি ফলকের জন্য লিখে রাখলেন এপিটাফ। অবশেষে ১৮৭৩ সালের ২৯শে জুন মাত্র ঊণপঞ্চাশ বছর বয়েসে তাঁর জীবনদীপ নিভে গেল। কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটারিতে কবির সমাধি স্থলে রয়েছে তাঁর মর্মর আবক্ষ মূর্তি। ফলকে উৎকীর্ণ তাঁরই লেখা লিপি..

তার মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণের পৌরাণিক কাহিনী থেকে সংগৃহীত হলেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবনার সংমিশ্রণে মধুসূদনের এ এক অপরূপ সৃষ্টি।

শেষ জীবনে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্থ ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ উঠেছিল। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় তিনি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

প্রেরক,

আঃজলিল