পাহাড় প্রিয়দের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠেছে পর্যটননগরী খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান।
মোঃ ইব্রাহিম শেখ চট্টগ্রাম ব্যুরোঃ
টানা ছুটিতে পাহাড় প্রিয়দের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠেছে পর্যটননগরী খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান। তিন দিনের টানা ছুটিতে খাগড়াছড়িতে রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক এসেছে। প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রে এখন উপচে পড়া ভীর। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয ও ঝর্ণার শীতলতায় গা ভাসাতে পাহাড়ি কন্যা খাগড়াছড়িতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন হাজারো সৌন্দর্য্য পিপাসু পর্যটক। হোটেল-মোটেলে সব আগাম বুকিং। দেখা দিয়েছে পরিবহন সংকটও। পর্যটকদের বাড়তি বিনোদন দিতে আলুটিলা পর্যটন পার্ক
এম্ফিথিয়েটারে বিভিন্ন জাগি-গোষ্ঠীর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির আলুটিলার পর্যটন কেন্দ্র, জেলা পরিষদ পার্কের ঝুলন্ত সেতু, রিছাং ঝর্ণা, আলুটিলা রহস্যময় সড়ঙ্গ,
মায়াবিনী লেকসহ প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রে এখন পর্যটকদের উপচে পড়া ভীর। নিরাপত্তার ঘাটতি না থাকায় রাত
পর্যন্ত পর্যটকরা ঘুরছেন নির্বিঘেœ। অতিরিক্ত পর্যটকের ভারে যেমন পরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে তেমনি
হোটেল-মোটেলেও সিট নেই। ফলে আসার আগে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আসতে হবে। অন্যথায় পরিবার-
পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে নয়নাভিরাম নানান দৃশ্য, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময়
জীবনধারা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতির নজরকাড়া হাজারো চিত্র। চারপাশে বিছিয়ে রাখা শুভ্র মেঘের চাদরের
নিচে রয়েছে সবুজ বনরাজিতে ঘেরা ঢেউ খেলানো অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়। তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে আঁকা-
বাঁকা সড়ক।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে খাগড়াছড়িতে আসা পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার রয়েছে বহু
হোটেল- রেস্টুরেন্ট। বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসায় হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরাও খুশি।
খাগড়াছড়ি হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি কল্যান মিত্র বড়ুয়া জানান, টানা ছুটিতে খাগড়াছড়িতে বিপুল
সংখ্যক পর্যটন এসেছে। এর ফলে বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে ব্যবসায়ীরা। খাগড়াছড়ি গাইরিং
হোটেলের ম্যানেজার প্রাপ্ত ত্রিপুরা জানান, খাগড়াছড়ির সবকটি হোটেল বুকিং হয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ি ট্যুরিস্ট পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর আবুল কাশেম জানান, খাগড়াছড়িতে আসা পর্যটক নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে প্রতিটি পর্যটন স্পটে নিয়োগ করা হয়েছে পোশাকের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
খাগড়াছড়িতে আসা পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার রয়েছে বহু হোটেল-রেস্টুরেন্ট। তবে আসার আগে আবাসন ও
আসা-যাওয়ার পরিবহন নিশ্চিত করে আসবেন। অন্যথায় বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এদিকে, শুক্রবার থেকে রাঙামাটিতে শুরু হয়েছে পর্যটক আগমন। টানা তিনদিনের ছুটিকে কাজে লাগাতে পর্যটন
মুখি হচ্ছে দেশি-বিদেশি পর্যকরা। মানুষের অরণ্যে পরিণত হয়েছে রাঙামাটি।
শুধু রাঙামাটি শহর নয়, পর্যটক উৎসবে মেতেছে বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নসহ অপর দুই পার্বত্য জেলা
খাগড়াছড়ি ও বান্দবান। পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত পাহাড়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। অগণিত পর্যটক আগমনে
তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই কোথাও। অগ্রীম বুকিং রয়েছে আবসিক হোটেল, মোটেল, সরকারি রেস্ট
হাউসগুলো। কোথাও রুম খালি নেই। সড়কে, সড়কে ভ্রমণ পিপাসুদের গাড়ির বহরের ভিড় যেন লেগে আছে।
সাজেক রিসোর্ট ও কটেজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিং থাং জাওয়া লুসাই জেরি বলেন, সম্প্রতি সাজেকে
অসংখ্য পর্যটক এসেছেন। কোনো রিসোর্ট ও কটেজ খালি নেই।
অন্যদিকে, রাঙামাটির শহর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রগুলো ছিল লোকে লোকারণ্যে
ভরপুর। প্রকৃতির টানে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-
স্বজনদের নিয়ে আগত পর্যটকরা রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝর্ণা, পলওয়েল পার্ক, ডিসি বাংলো পার্ক ও
কাপ্তাই-আসামবস্তী সড়কসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কাপ্তাই হ্রদ নৌ-ভ্রমণের আনন্দ
উচ্ছ্বাসে মেতেছে। আবার কেউ প্রকৃতিকে উজাড় করে দিচ্ছে নিজেকে।
সাজেকে বেড়াতে আসা মো. মামুন জানায়, একই চিত্র ছিল সাজেক ভ্যালীতে। হাজারো মানুষের পাদভারে
উৎসবের নগরিতে পরিণত হয় সাজেকের পাহাড়ি জনপদ। মীতের উষতায় সবুজ পাহাড়ের বুকচিরে উড়ে
বেড়ানো সুভ্র সাদা মেঘের ভেলায় যেন ভেসে বেড়াচ্ছে পর্যটকরা। তবে অগণিত পর্যটকদের কারণে ধারণ ক্ষমতা
হারিয়েছে হোটেল মোটেলগুলো। তবুও আনন্দের কমতি ছিল না।
রাঙামাটি পর্যটন মোটেল ও হলিডে কমপ্লেক্সর ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া জানান, রাঙামাটিতে বেড়েছে
পর্যটকদের আনাগোনা। পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রচুর। রাঙামাটি কমপ্লেক্সের পর্যটন
মোটেলের সবগুলো রুম ৮০ভাগ বুকিং রয়েছে। আর ঝুলন্ত সেতুতে পর্যটক আসছে অগণিত। শুধু দেশের
আশপাশের জেলার পর্যটকরাই নয়-এখানে আসছে বিদেশি পর্যটকও।
এছাড়া, বান্দরবান জেলার মেঘলা, নীলাচল, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, তমাতুঙ্গীসহ সবগুলো দর্শনীয় স্থানে
এখন পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়। নিষেধাজ্ঞা থাকায় দীর্ঘদিন পর্যটক না আসেনি এসব স্থানে। এতদিন পর
আশানুরূপ পর্যটকের আগমন ঘটায় খুশি এখানকার হোটেল-মোটেল-রিসোর্টের মালিকসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট
ব্যবসায়ীরা।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন
বহু পর্যটক। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে এ বছর শীত মৌসুমে তেমন একটা পর্যটকের আগমন না ঘটলেও
সাপ্তাহিক ছুটি ও বড়দিন উপলক্ষে টানা তিন দিনের ছুটি থাকায় ব্যাপক পর্যটকের সমাগম ঘটেছে বান্দরবানে।
সরেজমিন দেখা গেছে, যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা ভুলে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের
নিয়ে পর্যটকরা চাঁদের গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। জেলার মেঘলা, নীলাচল,
প্রান্তিক লেক, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, নীলদিগন্ত ও তমাতুঙ্গীসহ সবগুলো দর্শনীয় স্থান এখন ভ্রমণপিপাসুদের
পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। কেউ-বা ছুটে যাচ্ছেন ঝরনার সৌন্দর্য দেখতে, কেউ-বা ছুটে যাচ্ছে সুউচ্চ
পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে।অবকাশ যাপনে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুরা। চট্টগ্রাম থেকে আগত পর্যটক আবদুর রহমান জানান, সরকারি ছুটি পেয়ে তিনি অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে বান্দরবান এসেছেন। এখানকার প্রাকৃতিক
পরিবেশ তার খুব ভালো লাগছে। আরেক পর্যটক সোহেল চৌধুরী বলেন, ‘আমি অনেক দেশ বেড়িয়েছি। কিন্তু আমাদের দেশেও যে এত সুন্দর মনোরম দৃশ্য রয়েছে তা এখানে না আসলে জানতেও পারতাম না। আসলেই মন কেড়ে নেয় এখানকার প্রাকৃতিক
পরিবেশ।’
চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। নিজেকে সবুজ প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দিতে চান ঢাকা থেকে আসা নারী
পর্যটক নাদিরা জামান। তিনি বলেন, ‘বান্দরবান এত সুন্দর ভাবতেই পারছি না। এ যেন এক রঙিন স্বপ্ন।’
নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা আদীব বড়ুয়া জানান, দীর্ঘদিন পর বান্দরবানে বিপুল
সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। শুক্রবারই প্রায় আড়াই হাজারের বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে নীলাচল
পর্যটন স্পটে। শনিবার বিকালে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, দীর্ঘদিন পর টানা ছুটিতে আশানুরূপ পর্যটক আশায় খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে হোটেল
গার্ডেন সিটির মালিক জাফর বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর তিন দিনের টানা ছুটিতে বান্দরবানে প্রচুর পর্যটকদের আগমন
ঘটছে। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতেও এভাবে পর্যটকরা আসবেন।’
পর্যটকদের ভ্রমণ নিরাপদ ও আনন্দদায়ক করতে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান ট্যুরিস্ট
পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা
পোশাকেও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, জেলায় পর্যটকদের সেবায় রয়েছে শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউস। এ ছাড়াও পর্যটক
পরিবহনে রয়েছে চার শতাধিক চাঁদের গাড়ি। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলার ২০ হাজার মানুষ
পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।