অ্যাডভোকেট মো.রায়হান আলীঃ
ক্ষমতায় থাকা সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ খুব একটা সহজেই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়না। সত্যের মধ্যে অবিচল সাংবাদিক একজনও যদি এই অপকর্মের সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা-হামলার খড়গ। কিছু সময় সংবাদ মাধ্যম ভুল তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রচার করেনা এমনটা যে মোটেও করেনা তা বলা যাবেনা তবে অনেক সংবাদ মাধ্যম বিগত ক্ষমতাশীন সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার অকাট্য সত্য প্রকাশ করার পুরুস্কার স্বরুপ সংবাদ মাধ্যমটির প্রকাশ-প্রচার বন্ধ পর্যন্ত হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর এক এক করে পর্যায়ক্রমে উচ্চ পদস্থদের অনিয়ম-দুর্নীতির খতিয়ান সংবাদপত্রে প্রকাশ-প্রচার শুরু হয়েছে। আমার মত অনেকের প্রশ্ন যে,এত দিন এই সংবাদ মাধ্যমগুলো কোথায় ছিল বা কেনই বা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির কথা প্রকাশ-প্রচার করতে পারেনি। তাহলে কি আমরা ধরে নিব ক্ষমতাশীন বিগত সরকারের কার্যকলাপের অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরলে হয়ত সাংবাদিক গুম ও সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশ-প্রচারের বারোটা বাজার ভয়ে তা স্তব্ধ ছিল। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আজ কোথায়। সংবাদপত্র যদি শুধু ক্ষমতাশীনদের ভাল কাজগুলোর গুনগান গাইবে আর মন্দ কাজের গঠনমূলক সমালোচনার প্রতিবেদন প্রচার করতে পারবে না তাহলে এই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কোথায়! অথচ আমরা সব সরকারের আমলেই সাংবাদিকদের নির্বিঘ্নে কাজ করার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতের বুলি শুনে আসছি। বাস্তবে তা ভিন্ন! প্রবাদে আছে-‘কাজীর গরু কেতাবে আছে,গোয়ালে নেই’ ঠিক এমনটি।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থায় গণমাধ্যম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সংবাদ মাধ্যম গণমাধ্যমেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা প্রজাতন্ত্রের সুশাসন নিশ্চিত করতে সংবাদ মাধ্যম অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে । রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ও জনগুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সর্বোপরি সুশাসন যেমন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে ঠিক তেমনি সংবাদ মাধ্যম কোন রাষ্ট্র বা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে রাষ্ট্রকে উন্নয়নের দিকে তরান্বিত করতে সহায়তা করে। এদিক থেকে সংবাদ মাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় । এই সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণ রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রের অধিবাসীদের একান্ত জরুরী। কিন্তু আমাদের দেশের এই সংবাদ মাধ্যম কর্মীরা কতটা নিরাপদে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পাড়ছে তা পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিনিয়তই শুনে আসছি সাংবাদিক বা সংবাদকর্মী নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার। সংবাদকর্মীদের অত্যান্ত লাইফ রিক্স নিয়েই সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে হয়। অনেক কুল-প্রতিকুল অবস্থার মধ্য দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন এই সংবাদ কর্মীরা। অত্যান্ত দুঃখজনক হলেও সত্য সংবাদ মাধ্যম কর্মীরা আজ দায়িত্ব পালনে জীবন সংশয়ে। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর দল গোছানোর ব্যস্ততাকে আমরা দেখেছি। নিজ নিজ দলের ভিত্তি শক্ত রাখতে নানান প্রকার কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি দিয়ে আসছিল তারা। এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবর,২০২৩ তারিখে সেদিন পূর্ব ঘোষিত তিনটি রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ,বি,এন,পি ও জামাতের সমাবেশ রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির অবস্থান নয়াপল্টন,আওয়ামিলীগ এর অবস্থান বায়তুল মোকাররম মসজিদ এর দক্ষিণ চত্বর,জামাতের অবস্থান শাপলা চত্বর। সেদিন রাজধানী ঢাকার পরিবেশ ছিল থমথমে। সমাবেশগুলোর অনুষ্ঠান কাভারেজ করার জন্য সংবাদকর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করছিল কিন্তু তাতেও বাঁধা। অনেক সংবাদকর্মী আহত ও হতাহতের শিকার হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে এসেছে ‘রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সেদিন হামলার শিকার হয়ে আহত হয়েছিল অন্তত ১৭ জন সংবাদকর্মী। সেদিন সংবাদকর্মীরা ঢাকার কাকরাইল, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন ও বিজয়নগরসহ বিভিন্ন স্থানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তারা আক্রান্ত হন। তাদের অনেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। এসময় সাংবাদিকদের গাড়ি,ক্যামেরা, ভাঙচুরসহ মোবাইল, ট্যাব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেদিন আহত সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন, একাত্তর টেলিভিশনের নিজস্ব প্রতিবেদক সাজিদ সরকার, নিউ এজের আহমেদ ফয়েজ, বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক সালমান তারেক শাকিল, ফটো সাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন ও নিজস্ব প্রতিবেদক জোবায়ের আহমেদ, দৈনিক কালবেলার প্রতিবেদক রাফসান জানি, আবু সালেহ মুসা, রবিউল ইসলাম রুবেল ও তৌহিদুল ইসলাম তারেক, ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক সালেকিন তারিন, ব্রেকিং নিউজের ক্রাইম রিপোর্টার কাজী ইহসান বিন দিদার, দৈনিক ইনকিলাবের ফটোসাংবাদিক এফ এ মাসুম, দৈনিক ইত্তেফাকের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার তানভীর আহাম্মেদ, একুশে টিভির রিপোর্টার তৌহিদুর রহমান ও ক্যামেরা পারসন আরিফুর রহমান, দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাংবাদিক আরিফুর রহমান রাব্বি এবং ইত্তেফাকের সাংবাদিক শেখ নাছের ও ফ্রিল্যান্সার মারুফ। এছাড়া অনেক সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে মেমেরি কার্ড রেখে দিয়েছে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষে আহত এক সাংবাদিক জানান, আরামবাগ মোড়ে তিনটি কলেজের সামনে বিএনপির কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। চড়, ঘুষি দেওয়ার পর তারা ক্যামেরা নিয়ে গেছে। গাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক রিয়াদ খন্দকার বলেন, ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখি আহতের মধ্যে সাংবাদিক ও পুলিশের সংখ্যাই বেশি। ইত্তেফাকের জুনিয়র দুই সহকর্মী কর্তব্যরত অবস্থায় আহত হয়েছেন। তাদের জাতিগত দুশমনের মতো পেটানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক পিটিয়ে ক্ষমতা দখল করা যায় না’ -এই সহজ যুক্তিটা মুর্খগুলো কবে বুঝবে!। এই তাণ্ডবের শেষ কোথায় জানি না। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের সদস্য সচিব ও একাত্তর টেলিভিশনের হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ বলেন, অপরাধীরা বার বার নিজেদের বাঁচাতে সংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করে আসছে। আজও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখালাম। তিনি বলেন, এ সব ঘটনার ফুটেজ বিশেষ করে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশকেই মামলা করার আহবান জানাচ্ছি। সাংবাদিকরা রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে সত্য প্রকাশে কাজ করে। তাদের ওপর হামলা রাষ্ট্রের ওপর হামলা বলেই মনে করি। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকরা সব সময় দেশ, জাতি এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যখনই কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হয় তখনই কিন্তু সাংবাদিকরা নানাভাবে হামলার শিকার হন। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সাংবাদিকদের টার্গেট করে। যেমন আজকে এমনটা ঘটেছে। বিএনপি-জামায়াতের হাতের সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের বিভিন্ন ডিভাইস ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর এমন ঘটনা পুরো জাতির জন্য লজ্জার। ডিইউজের পক্ষ থেকে আমরা এ ধরনের হামলার নিন্দা এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত বিচারের দাবি জানাচ্ছি’। (সূত্রঃ একাত্তর,২৮ অক্টোবর ২০২৩,। এ ঘটনা আজ নতুন করে নয় ইতিপূর্বেও সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গত বছর ২০২২ সালের মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র তথ্যমতে, গত ১০ বছরে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩০ সাংবাদিক। বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ‘আর্টিকেল-১৯’র এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। প্রতিবেদটিতে বলা হয়েছে- ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এ হার হয় ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সাংবাদিকদের হয়রানির পরিমাণ বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। হয়রানির মধ্যে মানহানির দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। প্রতিবেদটিতে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালে ২১৩ জন সাংবাদিক ও আটজন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে চারজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, গুরুতর জখম হয়েছেন ৪০ জন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬২ জন সাংবাদিক। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রিডম হাউজ’র ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারে বিশ্বের ১৯৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ প্রকাশিত ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৪ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬। সূচকে বাংলাদেশের অবনতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এর আগে ২০১৩ সালে ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৪।
সংবাদপত্রের প্রাণ সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা আজ ভূলন্ঠিত হচ্ছে। সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা,নির্যাতন-হত্যা সাংবাদিকতা পেশাকে ক্রমাগত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। সংবাদপত্র দলীয় ক্ষমতাশীন সরকারের বলী হয়ে স্বাধীনভাবে কাজে বাঁধা পাচ্ছে। দুর্নীতি-অনিয়মের যাঁতাকল থেকে রাষ্ট্রকে
সংস্কারে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিত করা সরকার ও জনগনের একান্ত দায়িত্ব। রাষ্ট্র সংস্কারে সার্বিক উন্নয়নে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের উপযুক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া সময়ের দাবী।
শিরোনাম :
রাষ্ট্র সংস্কারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক। মোঃ মিজানুর রহমান স্টাফ
- Reporter Name
- Update Time : ১২:৫৫:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- ৫৬ Time View
Tag :
আলোচিত