Dhaka ০৯:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জুলুম ও জালিমের পরিণতি ভয়াবহ!

  • Reporter Name
  • Update Time : ১১:২১:১৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪
  • ৫৮ Time View

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

জুলুম একটি মহাপাপ। একটি মারাত্মক কবিরা গুনাহ। যার গন্তব্য হলো জাহান্নাম। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে চলছে আজ জুলুমের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। চারদিকে প্রকাশ পাচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার।

ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র আজ এই জুলুমে লিপ্ত। যার পরিণতি খুবই মন্দ ও ভয়াবহ। অন্যের ওপর অন্যায়-অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। যেমনটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

যার যা প্রাপ্য তাকে সেই প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নাম জুলুম। কারও অধিকার হরণ, বিনা অপরাধে নির্যাতন, আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন, মানহানিকর অপবাদ দেওয়া, দুর্বলের ওপর নৃশংসতা চালানো, নির্যাতন করা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হরণ, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল, উৎপীড়ন বা যন্ত্রণা ইত্যাদি কাজ জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের প্রতি জুলুম সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ।

এ কারণেই অত্যাচারিত ব্যক্তির আবেদন-নিবেদন আল্লাহতায়ালার দরবারে সরাসরি পৌঁছে যায়। আল্লাহতায়ালা মাজলুমের দোয়া খুবই দ্রুততার সঙ্গে কবুল করে থাকেন।

দুনিয়াতে খুব কম জালিমই নিজেকে জালিম মনে করে। আবার জালিম যখন মাজলুম এবং দুর্বলের প্রতি অত্যাচার চালায়, তখন সে নিজেকে মনে করে অনেক ক্ষমতাবান। ভাবে তার অর্থবিত্ত, শক্তি ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী। মনে করে তার সহযোগী অনেক। কিন্তু সে ভুলে যায়, ওই অসহায় লোকটির পক্ষে কেউ না থাকলেও মহান আল্লাহতায়ালা তার সঙ্গে আছেন। তিনি সবই দেখেন ও হিসাব রাখেন।

পৃথিবীতে জালিমের অন্যায়-অত্যাচার আর অবৈধ শক্তির ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত ও ভীত থাকে। অনেক অসহায় প্রাণ দুই হাত তুলে জালিমের ধ্বংস প্রার্থনা করে। আজ যে জালিম নিজেকে শক্তিশালী অনুভব করে এবং শক্তির দাপটে দুর্বলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, কাল কেয়ামতের দিন সে নিজেকে মারাত্মক দুর্বল ও দরিদ্র অনুভব করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, জালিমদের কোনো বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে। (সূরা মুমিন, আয়াত : ১৮)।

মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছোটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস।

সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক কর যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, যেদিন জালিমরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কিছু কালের জন্য অবকাশ দাও, আমরা তোমার আহ্বানে সাড়া দেব এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। (তখন তাদের বলা হবে,) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোনো পতন নেই? (সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪২-৪৪)।

পবিত্র কুরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি অগ্নি। যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে। তারা পানীয় চাইলে তাদের দেওয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে। এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়। জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়। (সূরা কাহাফ, আয়াত : ২৯)।

এভাবে কুরআনের অনেক আয়াত রয়েছে, যাতে জালিমের কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ জালিমকে ছাড় দেন। কিন্তু ছেড়ে দেন না। জালিমকে তার জুলুমের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। মাজলুমের কাছে মাফ চেয়ে মাফ করানো ছাড়া এ শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কারণ তা বান্দার হক-এর অন্তর্ভুক্ত।

মাজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ জালিমের পতনের অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মাজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)।

অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, মাজলুমের বদদোয়াকে ভয় কর। কেননা মাজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরাল নেই। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮৬)। অর্থাৎ মাজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়।

শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের জন্য ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত থাকা শর্ত। যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি জুলুম করে সে কেবল অন্যেরই ক্ষতি করে না, নিজ জীবনের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলে। আর সমাজের অধিকাংশ লোকেরই যখন চরিত্র হয় জুলুমবাজি অর্থাৎ যারা পারস্পরিক হক আদায়ের কোনো তোয়াক্কা করে না, সে সমাজ দুর্যোগকবলিত হবেই। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা আমার (নবির) কথা শোনো, তা হলে বেঁচে থাকতে পারবে। সাবধান! তোমরা জুলুম কর না। সাবধান তোমরা জুলুম কর না। সাবধান তোমরা জুলুম কর না! (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৬৯৫)।

আল্লাহতায়ালা নিজের জন্য জুলুম হারাম করেছেন, তেমনি বান্দাদের জন্য জুলুমকে হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, হে আমার বান্দারা! আমি জুলুম করাকে নিজের প্রতি হারাম করেছি এবং তাকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং পরস্পর পরস্পরের প্রতি জুলুম কর না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৭)।

মাজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। মাজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।

যারা জুলুম করে এমন কাউকে মহান আল্লাহ অতীতে ছেড়ে দেননি। তার শেকড় যতই শক্ত হোক। ফেরাউন ও নমরুদ তাদের শক্তির দাম্ভিকতায় নিজেদের রব বলে দাবি করেছে। স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং তার পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের সব নবজাতক ছেলে সন্তানদের হত্যা করেছে। তারা নিজেদের সর্ব ক্ষমতার অধিকারী ভেবেছিল।

মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি কারুন, ফেরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মূসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা ভূমিতে দম্ভ করল। তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা। কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ। কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। …আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই কেবল তা বোঝে। (সূরা আনকাবুত আয়াত : ৩৯-৪০, ৪৩)।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ফেরাউন সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ (ফেরাউনকে) বলল, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে মুক্ত ছেড়ে দেবেন, যাতে তারা (অবাধে) পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদের বর্জন করতে পারে? সে বলল, আমরা তাদের পুত্রদের হত্যা করব এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখব। আর তাদের ওপর আমাদের পরিপূর্ণ ক্ষমতা আছে। (সূরা আরাফ, আয়াত : ১২৭)।

আরও এরশাদ হয়েছে, ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় আর অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদের পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা কাসাস, আয়াত : ৩৯-৪০)।

মহান আল্লাহতায়ালা কারুনের পরিণতি সম্পর্কে বলেন, কারুন ছিল মূসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভান্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলো বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। স্মরণ কর, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না, নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না। …সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতেও তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং লোকবলেও বেশি ছিল? অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। …পরিণামে আমি তাকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম।

তার পক্ষে এমন কোনো দল ছিল না, যারা আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে। … ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেসব লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূল থাকবে। (সূরা কাসাস, আয়াত : ৭৬, ৭৮, ৮১, ৮৩)।

আমাদের মনে রাখা দরকার, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন এমন এক অপরাধ যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মজলুম ব্যক্তি (যার প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে) জালিমকে (অত্যাচারী ব্যক্তিকে) মাফ না করেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালেমদের সহযোগী হবে না, তাহলে আগুন (জাহান্নামের) তোমাদেরও স্পর্শ করবে (সূরা হুদ, আয়াত : ১১৩)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা জালিমকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যেন উপরোক্ত আলোচনা গুলোর প্রতি গুরুত্ব সহকারে বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

বোয়ালমারীতে চার বছর কর্মস্থলে না গিয়েও বেতন ভাতা নিচ্ছে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঝুমা !

জুলুম ও জালিমের পরিণতি ভয়াবহ!

Update Time : ১১:২১:১৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

জুলুম একটি মহাপাপ। একটি মারাত্মক কবিরা গুনাহ। যার গন্তব্য হলো জাহান্নাম। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে চলছে আজ জুলুমের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। চারদিকে প্রকাশ পাচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার।

ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র আজ এই জুলুমে লিপ্ত। যার পরিণতি খুবই মন্দ ও ভয়াবহ। অন্যের ওপর অন্যায়-অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। যেমনটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

যার যা প্রাপ্য তাকে সেই প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নাম জুলুম। কারও অধিকার হরণ, বিনা অপরাধে নির্যাতন, আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন, মানহানিকর অপবাদ দেওয়া, দুর্বলের ওপর নৃশংসতা চালানো, নির্যাতন করা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হরণ, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল, উৎপীড়ন বা যন্ত্রণা ইত্যাদি কাজ জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের প্রতি জুলুম সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ।

এ কারণেই অত্যাচারিত ব্যক্তির আবেদন-নিবেদন আল্লাহতায়ালার দরবারে সরাসরি পৌঁছে যায়। আল্লাহতায়ালা মাজলুমের দোয়া খুবই দ্রুততার সঙ্গে কবুল করে থাকেন।

দুনিয়াতে খুব কম জালিমই নিজেকে জালিম মনে করে। আবার জালিম যখন মাজলুম এবং দুর্বলের প্রতি অত্যাচার চালায়, তখন সে নিজেকে মনে করে অনেক ক্ষমতাবান। ভাবে তার অর্থবিত্ত, শক্তি ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী। মনে করে তার সহযোগী অনেক। কিন্তু সে ভুলে যায়, ওই অসহায় লোকটির পক্ষে কেউ না থাকলেও মহান আল্লাহতায়ালা তার সঙ্গে আছেন। তিনি সবই দেখেন ও হিসাব রাখেন।

পৃথিবীতে জালিমের অন্যায়-অত্যাচার আর অবৈধ শক্তির ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত ও ভীত থাকে। অনেক অসহায় প্রাণ দুই হাত তুলে জালিমের ধ্বংস প্রার্থনা করে। আজ যে জালিম নিজেকে শক্তিশালী অনুভব করে এবং শক্তির দাপটে দুর্বলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, কাল কেয়ামতের দিন সে নিজেকে মারাত্মক দুর্বল ও দরিদ্র অনুভব করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, জালিমদের কোনো বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে। (সূরা মুমিন, আয়াত : ১৮)।

মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছোটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস।

সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক কর যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, যেদিন জালিমরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কিছু কালের জন্য অবকাশ দাও, আমরা তোমার আহ্বানে সাড়া দেব এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। (তখন তাদের বলা হবে,) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোনো পতন নেই? (সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪২-৪৪)।

পবিত্র কুরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি অগ্নি। যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে। তারা পানীয় চাইলে তাদের দেওয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে। এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়। জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়। (সূরা কাহাফ, আয়াত : ২৯)।

এভাবে কুরআনের অনেক আয়াত রয়েছে, যাতে জালিমের কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ জালিমকে ছাড় দেন। কিন্তু ছেড়ে দেন না। জালিমকে তার জুলুমের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। মাজলুমের কাছে মাফ চেয়ে মাফ করানো ছাড়া এ শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কারণ তা বান্দার হক-এর অন্তর্ভুক্ত।

মাজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ জালিমের পতনের অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মাজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)।

অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, মাজলুমের বদদোয়াকে ভয় কর। কেননা মাজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরাল নেই। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮৬)। অর্থাৎ মাজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়।

শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের জন্য ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত থাকা শর্ত। যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি জুলুম করে সে কেবল অন্যেরই ক্ষতি করে না, নিজ জীবনের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলে। আর সমাজের অধিকাংশ লোকেরই যখন চরিত্র হয় জুলুমবাজি অর্থাৎ যারা পারস্পরিক হক আদায়ের কোনো তোয়াক্কা করে না, সে সমাজ দুর্যোগকবলিত হবেই। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা আমার (নবির) কথা শোনো, তা হলে বেঁচে থাকতে পারবে। সাবধান! তোমরা জুলুম কর না। সাবধান তোমরা জুলুম কর না। সাবধান তোমরা জুলুম কর না! (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৬৯৫)।

আল্লাহতায়ালা নিজের জন্য জুলুম হারাম করেছেন, তেমনি বান্দাদের জন্য জুলুমকে হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, হে আমার বান্দারা! আমি জুলুম করাকে নিজের প্রতি হারাম করেছি এবং তাকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং পরস্পর পরস্পরের প্রতি জুলুম কর না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৭)।

মাজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। মাজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।

যারা জুলুম করে এমন কাউকে মহান আল্লাহ অতীতে ছেড়ে দেননি। তার শেকড় যতই শক্ত হোক। ফেরাউন ও নমরুদ তাদের শক্তির দাম্ভিকতায় নিজেদের রব বলে দাবি করেছে। স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং তার পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের সব নবজাতক ছেলে সন্তানদের হত্যা করেছে। তারা নিজেদের সর্ব ক্ষমতার অধিকারী ভেবেছিল।

মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি কারুন, ফেরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মূসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা ভূমিতে দম্ভ করল। তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা। কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ। কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। …আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই কেবল তা বোঝে। (সূরা আনকাবুত আয়াত : ৩৯-৪০, ৪৩)।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ফেরাউন সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ (ফেরাউনকে) বলল, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে মুক্ত ছেড়ে দেবেন, যাতে তারা (অবাধে) পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদের বর্জন করতে পারে? সে বলল, আমরা তাদের পুত্রদের হত্যা করব এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখব। আর তাদের ওপর আমাদের পরিপূর্ণ ক্ষমতা আছে। (সূরা আরাফ, আয়াত : ১২৭)।

আরও এরশাদ হয়েছে, ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় আর অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদের পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা কাসাস, আয়াত : ৩৯-৪০)।

মহান আল্লাহতায়ালা কারুনের পরিণতি সম্পর্কে বলেন, কারুন ছিল মূসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভান্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলো বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। স্মরণ কর, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না, নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না। …সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতেও তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং লোকবলেও বেশি ছিল? অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। …পরিণামে আমি তাকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম।

তার পক্ষে এমন কোনো দল ছিল না, যারা আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে। … ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেসব লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূল থাকবে। (সূরা কাসাস, আয়াত : ৭৬, ৭৮, ৮১, ৮৩)।

আমাদের মনে রাখা দরকার, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন এমন এক অপরাধ যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মজলুম ব্যক্তি (যার প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে) জালিমকে (অত্যাচারী ব্যক্তিকে) মাফ না করেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালেমদের সহযোগী হবে না, তাহলে আগুন (জাহান্নামের) তোমাদেরও স্পর্শ করবে (সূরা হুদ, আয়াত : ১১৩)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা জালিমকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যেন উপরোক্ত আলোচনা গুলোর প্রতি গুরুত্ব সহকারে বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।