উলিপুরে হাতিয়া গণহত্যার ৫১ বছর আজও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
নুর মোহাম্মদ রোকন বিশেষ প্রতিনিধিঃ
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ১৩ নভেম্বর বর্বরোচিত হাতিয়া গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক-হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহযোগীতায় নিরীহ ৬’শ ৯৭ জন গ্রামবাসিকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। উলিপুর সদর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পূর্ব দিকে ব্রহ্মপূত্র নদ বেষ্ঠিত হাতিয়া ইউনিয়নের দাগারকুটি গ্রামের ঘুমন্ত এসব নিরীহ মানুষকে ধরে এনে পাকিস্তানী হায়নারা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে জঘন্যতম নারকীয় এ হত্যাকান্ডের ইতিহাস জাতীয় পর্যায়ে তেমন গুরুত্ব না পেলেও উলিপুরে মানুুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
আজও নিহত শহীদদের স্বজনরা খুঁজে ফিরে তাদের আপনজনকে। দাগারকুটি গ্রামটিকে ঘিরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে এলাকার মানুষজন প্রতি বছর শহীদদের স্মরণ করে আসছিল। কিন্তু করালগ্রাসী ব্রহ্মপূত্র নদ দাগারকুটি গ্রামটিই তার বুকে ধারন করে নিয়েছে। বর্তমানে অনন্তপুর বাজারের পশ্চিম দিকে নতুন করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দিবসটি প্রতি বছর পালন করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা যুদ্ধের এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ হয়তো মানুষের হৃদয় থেকে মুছে যাবে, কিন্তু শহীদের স্বজনরা তাদের আপনজনদের স্মরণ করবেন সারাজীবন নিরবে-নিভৃতে।
১৯৭১ সালের সেই নারকীয় রক্তঝরা দিনটি ছিল ২৩ শে রমজান, শনিবার। গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ সেহরীর খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কেউ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ফজরের নামাজের আযান ধ্বনিত হচ্ছে মসজিদে মসজিদে। নামাজের প্রস্তুতি নিতে অজুও সেরে ফেলেছেন অনেকে। হঠাৎ পাকিস্তানী হায়নাদের মর্টার সেল আর বন্দুকের অবিরাম গুলি বর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে দাগারকুটি গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলো। মানুষজন কিছু বুঝে উঠার আগেই পাকিস্তানী হায়নারা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী মিলে নিরীহ গ্রামবাসিদের বাড়ী-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর সাথে চলতে থাকে লুটপাঠ ও নির্যাতন।
আকস্মিক এ পরিস্থিতিতে এলাকার নিরীহ মানুষজন উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি শুরু করেন। পাকিস্তানী বাহিনীর ছোঁড়া বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণে মানুষজন জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতসহ ঝোঁপ-জঙ্গলে শুয়ে জীবন বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অনেকে ব্রহ্মপূত্র নদে ঝাঁপ দিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অসহায় বৃদ্ধ আর শিশুদের আত্মচিৎকারে এলাকার আকাশ-বাতাশ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠে। এসব অসহায় গ্রামবাসীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টা মুহুর্তেই শেষ হয়ে যায়। পাক-হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহযোগীতায় আত্মগোপন করা মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে এসে দাগারকুটিতে জড়ো করে হাত-পা বেঁধে নির্দয় ভাবে গুলি করে হত্যা করে। তাদের এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে সেদিন বৃদ্ধ থেকে শুরু করে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটিও রক্ষা পায়নি। দিনব্যাপী চলে পাক-হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগ। আগুনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়, হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর, দাগারকুটি, হাতিয়া বকসি, রামখানা ও নয়াদাড়া গ্রামের শত শত ঘর-বাড়ী। মুহূর্তেই গ্রামগুলো পরিণত হয় ধ্বংস স্তুপে। সেগুলো আজ শুধুই স্মৃতি।
বয়সের ভারে ন্যুয়ে পরা স্বামী হারানো কচভান বেওয়া (৯০) এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বাবা ওরা স্বামীকে গুলি করি মারি ফেলাইছে। স্বামীর কথা মনোত উঠলে কিছু ভালো লাগে না। এসব কথার এক পর্যায়ে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।
একই কথা জানালেন জুলাপ বিবি (৮৫)। তিনি আরো বলেন, মুই (আমি) শুধু স্বামীকে হারাং নাই। তিন দেবর, শ্বশুরকেও হারাইছোং। ওরা কাকো বাইচপার (কাউকে বাচতে) দেয় নাই। হাতিয়া গণহত্যার ৫১ বছর কেটে গেলেও এসকল স্মৃতি তাদের মনতে বিচলিত করে তোলে। হাতিয়া গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারগুলোর দাবী হাতিয়া গণহত্যা দিবস জাতীয় পর্যায়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনসহ ক্ষতিগ্রস্থ শহীদ পরিবার গুলোকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পূনর্বাসন করা হউক।