১ কোটি ১৭ লাখ টাকা বাগবাটোয়ারা!
নিজস্ব প্রতিবেদক : ময়মনসিংহের ত্রিশাল আব্বাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসার দোকান বরাদ্দের ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও স্থানীয় সাংসদ এবিএম আনিছুজ্জামানের ভগ্নিপতি আব্দুর রাজ্জাক ও সাবেক সভাপতি এমপির চাচা ভাই স্বপনের সুকৌশলে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। এমন পুকুরচুরি হওয়ার পর বর্তমান সভাপতি ড. মোঃ ইদ্রিস খান অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুলকে টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য বার বার তাগিদ দেন।
তারপরও টাকা জমা না দেওয়ায় অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হক সাময়িক বরখাস্ত করেন পরিচালনা কমিটি। প্রায় একবছর সাময়িক বরখাস্ত থাকার পর কমিটির কাছে তিনি শিকার করেন যে, একমাসের মধ্যে মাদ্রাসার দোকান বরাদ্দের ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা করবেন এবং সকল হিসাব-নিকাশ কমিটির নিকট লিখিতভাবে জমা দিবেন। তারপর এমন শর্তে অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হকের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার কমিটি। কিন্ত তিনমাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও ব্যাংকে টাকা জমা করা হয়নি বরং সভাপতি ড. মোঃ ইদ্রিস খানকে স্থানীয় এমপি আনিছুজ্জামান দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হকের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অশালিন আচরণ এবং মানহানীকর কথাবার্তা বলতে থাকেন।
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ড. মোঃ ইদ্রিস খান সেচ্ছায় সভাপতির পদ থেকে সরে না গেলে ত্রিশালে আসলে তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন এমপি আনিছুজ্জামানের ভগ্নিপতি আব্দুর রাজ্জাক ও মাদ্রাসার সাবেক সভাপতি এমপির চাচা তো ভাই স্বপন।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হক মাদ্রাসার দোকান বরাদ্দের ১কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা না দিতে বিভিন্ন সময়ে টালবাহানা শুরু করেন এবং মাদ্রাসায় কোন সভা আহবান করলে হিসাব দাখিল করতে হবে তাই ভয়ে সভা আহবান করেন না।
এতেই প্রতিয়মান হয় যে সাবেক সভাপতি স্বপন ও অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হক প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এখানেই শেষ নয় মাদ্রাসার টাকা জমা দিতে অধ্যক্ষকে বার বার তাগিত করায় সভাপতি ড. মোঃ ইদ্রিস খানকে সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করতে বিভিন্ন সময় মাদ্রাসা বোর্ড,বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল স্থানে এমপি নিজে গিয়ে মিথ্যা,বানোয়াট ও হয়রানিমূলক অভিযোগ জমা দেন এবং অশালিন কথাবার্তা বলে আসেন । যা একটি কথাও সত্য নয়।
অভিযোগ আছে, ত্রিশাল উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্টান তাদের নিয়ন্ত্রনে নিতে নিরহ শিক্ষকদের ওপর চাপপ্রয়োগ করেন এবং এমপি আনিছুজ্জামানের ভগ্নিপতি আব্দুর রাজ্জাক,চাচা ভাই স্বপন,মিন্টুসহ ১২ জনের একটি সিন্টিকেট উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্টান, জমিদখল,সালিশ বানিজ্যসহ সকল ধরনের অপকর্ম করে চলেছেন। মাদ্রাসার এক শিক্ষক জানান,এমপি স্যারের ডিও লেটার টাকার বিনিময়ে নিতে হয়। আমাকে একটি মাদ্রাসার সুপার বানাতে আব্দুর রাজ্জাক ৪ লাখ টাকা নেন। টাকা নেওয়ার পর থেকে তিনি আর ফোন রিসিভ করেন না। আমি খুব বিপদে আছি। আরেক ব্যাক্তি অভিযোগ করে বলেন, তাকে দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি বানাবে মর্মে ২ লাখ টাকা নেন আব্দুর রাজ্জাক। ৪ মাসেও সভাপতি বানাতে পারেননি তিনি। এখন টাকা চাইলে পুলিশের ভয় দেখায়। বলে জামাত সদস্য বানিয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠাবে।
উপজেলায় ইতিমধ্যে ৯ টি মাদ্রাসা তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এমপির পছন্দের লোকদের সভাপতি বানিয়েছেন। মার্কেটের পায় ৪০টি দোকানের মধ্যে ৩৫টি দোকান বরাদ্দ দেয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হক । বর্তমান মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির ১৪ জন সদস্যদের সিদ্ধান্তে ও গণস্বাক্ষরে ১ কোটি ১৭ লাখ দুর্নীতি ফিরিস্তি তোলা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রভাব বিস্তার করে তার আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে মাদ্রাসার উন্নয়নমুলক কাজ বন্ধ করে জমাকৃত অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়। আব্বাসীয় ফাজিল মাদ্রাসার দোকান ঘর ভাড়া দিয়ে জামানতের ৫৪ লাখ ও ৬৩ লাখ টাকা সর্বমোট ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা বিধি বহির্ভূতভাবে খরচ ও সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ করেন।
কমিটির সকল সদস্যগণ রেজুলেশনে উল্লেখ করেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফজলুল হক কত টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেছেন কমিটির কোন সদস্যকে আজও অবগত করেননি এবং ভুয়া অভিজ্ঞতা দেখিয়ে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি । এই মর্মেও তাকে বারবার কমিটি নোটিশ করেছেন। তারপরও কোন লিখিত বা মৌখিক জবাব দেয়নি।
আব্বাসিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের কাছে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি সহ কোন সদস্যকে জবাব দিতে নারাজ। মাদ্রাসার আয়কৃত টাকা সাধারণ তফসিলে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তাহা জমা দেননি অধ্যক্ষ। অভিযোগ আছে, মাদ্রাসার উন্নয়ন কাজের জন্য কোন প্রকার অর্থ কমিটি নেই। টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে কমিটির সকল সদস্যদের বিধান রয়েছে। কিন্তু অধ্যক্ষ কমিটির সকল সদস্যকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ আত্মসাৎ করে গাজীপুরে জমি ক্রয় করে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন অধ্যক্ষ। যার খরচ অনুমান ২ কোটি টাকা।
রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়, টাকা ও নির্ধারিত ভাড়ার টাকা উত্তোলন করে ব্যাংক হিসেবে জমা না করে অধ্যক্ষ ও সাবেক সভাপতি নিজের ইচ্ছা মাফিক খরচ করেন। যার বাৎসরিক কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকাশ বর্তমান কমিটির কোন অনুমোদন নেননি। অভিযোগ রয়েছে ১৫ই আগস্ট মহান স্বাধীনতা দিবসে উক্ত মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেননি। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ কে পরিচালনা কমিটি মৌখিকভাবে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ফজলুল হক জাতীয় পতাকা টানাতে হবে এমন কোন বিধান তার কাছে নেই। অভিযোগ আছে, অধ্যক্ষ ফজলুল হক দোকান ভাড়া উত্তোলন করে ব্যাংকে টাকা জমা দেন নাই।
এবং তিনি প্রতিষ্ঠানে নির্মিতভাবে উপস্থিত থাকেন না।
অধ্যক্ষ ফজলুল হক, মাদ্রাসা বিভিন্ন সময়ে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গত ৪/৯/২০২২ তারিখে পরিচালনা কমিটির তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত তদন্ত কমিটিতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিচালনা কমিটির কোন চিঠির উত্তর দুর্নীতি প্রাথমিক প্রমাণিত হওয়ায় গত ৭/১১/২০২২ ইং তারিখে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অধ্যক্ষ সাময়িক দরখাস্ত থাকা কালীন সময়ে ৫০% বেতন উত্তোলন করতে পারবেন।
কমিটির রেজুলেশনের এমন সিদ্ধান্ত হয়। মাদ্রাসা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আরবি প্রভাষক এনামুল হককে কমিটির সিদ্ধান্তে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার একক সিদ্ধান্ত হয় এবং অধ্যক্ষ ফজলুল হকের বিভিন্ন দুর্নীতি অর্থ আত্মসাৎ বিষয়ে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার জন্য ৫ সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয় পত্রের মাধ্যমে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,মাদ্রাসা বোর্ড ও শিক্ষা বোর্ডকে কমিটির রেজুলেশন এর মাধ্যমে জানানো হয়। প্রত্যেক কপি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত কমিটির প্রদান করা হয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনোনীত প্রতিনিধিসহ ৫ জন।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব এবিএম আনিছুজ্জামানের একক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন সময় শিক্ষা প্রতিষ্টানে প্রভাব বিস্তার করছেন। বর্তমান সভাপতি আলহাজ্ব অধ্যক্ষ ডক্টর ইদ্রিস খানকে বিভিন্ন সময় প্রাননাশের হুমকি দেন। এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকদের সেরা সংগঠন জমিয়াতুল মোর্দারেছিনের নেতারা সংগঠনের নিজস্ব প্যাডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,শিক্ষামন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেন এবং এহেন কর্মকান্ড বন্ধ না করলে সারাদেশে আন্দোলনের ডাক দিবেন বলে জানান শিক্ষক নেতারা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিস্তার থাকলে শিক্ষার মানক্ষুন্ন হবে বলে জানান স্থানীয় শিক্ষক নেতারা। অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হকের কাছে বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বার্তা পাঠিয়েও কোন উওর মেলেনি। এ বিষয়ে আব্বাসীয় ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি আলহাজ্ব ডক্টর ইদ্রিস খান জানান, অধ্যক্ষ ফজলুল হক ক্ষমতা প্রয়োগ করে মাদ্রাসা দোকান বরাদ্দের প্রায় এক কোটি ১৭ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। একারনে তাকে বিধি মোতাবেক সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব এবিএম আনিছুজ্জামানের বক্তব্য জানতে চাইলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার ভগ্নিপতি আব্দুর রাজ্জাকের কাজে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার একটা সিস্টেমের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসছি। প্রতিপক্ষরা অনেক কিছুই বলবে।
ত্রিশাল থানার ওসি কামাল উদ্দিন জানান, আব্বাসিয়া ফাজিল মাদ্রাসা একজন শিক্ষক আমার কাছে এসেছিল। তিনি মৌখিকভাবে বলেছেন তাকে প্রাননাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ত্রিশাল উপজেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, আনিছুজ্জামান এমপি হওয়ার পর সাব রেজিস্ট্রি অফিস, থানায় সালিশ বানিজ্য,বালু মহল,জমিদখল,তদবির বানিজ্য,কিশোর গ্যাংসহ সকল অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এমনটা আশা করিনি। ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুয়েল আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে মোখিকভাবে শুনেছি। অভিযোগ পেলে তদন্ত তদন্তপুবক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ত্রিশাল পৌরসভার মেয়র আমিন সরকার জানান, কে ভাল , কে খারাপ তা জনগনই প্রমাণ করেছেন। আমি জনগণের সেবা করতে চাই।
ত্রিশাল আসনের সাবেক এমপি হাফেজ রুহুল আমিন মাদানি জানান, আমার সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে । যা ত্রিশালবাসী আজীবন মনে রাখবে। তিনি আরো বলেন, এখন এমপি সাহেব যা করছেন তা কিছুদিন পর সবাই জানতে পারবে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল নিয়ে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে এমপির লোকজন।
ত্রিশাল সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন সরকার জানান, আমি তার বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। সময় বলে দিবে, কি বলতে হবে। অতিরিক্ত কিছু ভালো নয়।